বন্ধ্যাত্বের বিকল্প চিকিৎসাঃ টেস্ট টিউব বেবি

স্বাভাবিক পদ্ধতিতে গর্ভধারণ সব দম্পতিদের জন্যই কাম্য। কিন্তু কখনও যদি এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখা দেয় যখন স্বামী বা স্ত্রীর কোন ত্রুটি দেখা দিল, আর কোনো ধরনের চিকিৎসায় সন্তান গর্ভধারণ সম্ভব হচ্ছে না, তখন বন্ধ্যাত্বের এসব সমস্যা দূর করতে চিকিৎসকরা সেসব দম্পতিদের অনেক সময় টেস্ট টিউব বেবির পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

টেস্টটিউব প্রক্রিয়া যেভাবে কাজ করে:

এই পদ্ধতিতে স্ত্রীর ডিম্বাশয় থেকে পরিপক্ক ডিম্বানু এবং স্বামীর শুক্রাণু সংগ্রহ করে একটি টেস্ট টিউব বা বিশেষ ধরনের পাত্রে রেখে পরবর্তীতে তা কয়েক ঘন্টা রাখা হয় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত ইনকিউবিটরে।পর্যবেক্ষণ করে দেখা হয় উপযুক্ত শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর নিষেকের ফলে মানব ভ্রুনের সৃষ্টি হয়েছে কিনা সফলভাবে ভ্রুনের সৃষ্টি হলে তা এক বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে স্ত্রীর জরায়ুতে তা প্রতিস্থাপন করা হয়।

কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে, যাদের ডিম্ব উৎপাদন ওষুধের সাহায্যে করা হয় এবং মাসিক চক্র স্বাভাবিক থাকার সম্ভাবনা কম, তাদের ক্ষেত্রে ভ্রুনের প্রতিস্থাপনের জন্য পরবর্তী স্বাভাবিক মাসিক চক্রের অপেক্ষা করতে হয়। এসময় পর্যন্ত ভ্রুন কোষটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় হিমায়িত করে রাখা হয়। সব ভ্রুন অবশ্য কাজে লাগানো হয় না। গর্ভধারণ নিশ্চিত করতে ভ্রুণের গুণগত মান পরীক্ষা করে স্কোরিং করা হয়। ভ্রুন কোষের সংখ্যা যথাযথ বৃদ্ধি ও বংশবৃদ্ধির গতির উপর ভিত্তি করে উপযুক্ত ভ্রুন বাছাই করা হয়।

যেসব ক্ষেত্রে টেস্ট টিউব পদ্ধতি প্রযোজ্য:

§  নারীর টিউবাল ডিফেক্ট বা ডিম্বনালীর সমস্যা। এ সমস্যার কারনে শুক্রাণু জরায়ুতে প্রবেশ করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়।

§  ডিম্বাশয় ঠিক থাকার পরও জন্মগতভাবে বা রোগের কারণে ডিম্বনালী সঙ্কুচিত হলে, নষ্ট হলে, এর মুখ বন্ধ হয়ে গেলে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়।

§  পুরুষের ক্ষেত্রে কার্যকর শুক্রাণুর সংখ্যা কম থাকলে বা জরায়ুর মুখ থেকে ডিম্বনালী পর্যন্ত প্রয়োজনীয় শুক্রাণু যেতে অসমর্থ হলেও এ পদ্ধতির সাহায্য নেয়া যেতে পারে।

 

স্বাভাবিক পদ্ধতিতে জন্মগ্রহণকারী সন্তান এবং টেস্টটিউব পদ্ধতিতে জন্মগ্রহণকারী সন্তান:

 

একজন স্বাভাবিক সন্তান গর্ভধারণকারী মায়ের জরায়ুতে বেড়ে ওঠা শিশুর সঙ্গে টেস্টটিউব বেবির কোনো পার্থক্য নেই। তাছাড়া টেস্টটিউব বেবি জন্মদানের প্রক্রিয়াটি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

 

শুধুমাত্র ভ্রুণ তৈরীর প্রক্রিয়াটি দেহের বাইরে সংগঠিত হচ্ছে। পরবর্তীতে পরিপূর্ণ বিকশিত ভ্রুণটিকে স্ত্রীর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নারীর গর্ভে যেভাবে ভ্রুণ বিকশিত হয়ে সন্তানে পরিণত হয়, ঠিক তেমনি টেস্টটিউব পদ্ধতিতেও সন্তান একইভাবে বিকশিত হতে থাকে।

 

অনেকের মধ্যে এই ধারণা প্রচলিত যে টিস্ট টিউব পদ্ধতিতে জন্মগ্রহণকারী সন্তানের আয়ু খুব কম। এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা।তবে টেস্টটিউব পদ্ধতিতে কোন কোন সময় এক সাথে অনেক সন্তান জন্ম নিতে পারে। এসবক্ষেত্রে শিশুর পুষ্টিগত সমস্যা দেখা দেয়া এবং মায়ের কিছু শারীরিক সমস্যা ছাড়া তেমন কোন সমস্যা নেই।

 

নির্দিষ্ট কিছু কারণে বন্ধ্যাত্ব হলে সেক্ষেত্রে টেস্টটিউব বেবি পদ্ধতির সাহায্য নিতে হয়। মূলত নিঃসন্তান দম্পতিরাই এই চিকিৎসা নিয়ে থাকেন।

 

টেস্টটিউব বেবির জন্য দম্পতিদের যেসব নিয়ম মেনে চলতে হয়:

·        যেসব দম্পতি অধুমপায়ী, এলকোহলিক নন এবং কোনরূপ ড্রাগে আসক্ত নন তাদের জন্য এ পদ্ধতি কার্যকর।

·        পদ্ধতি গ্রহণকারীদের দিনে দুইবারের বেশি ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় গ্রহণ করা উচিত নয়।

·        গোসলে গরম পানির ব্যবহার এড়িয়ে চলা উচিত।

·        সাধারণ ব্যায়াম করা যেতে পারে, তবে লক্ষ্য রাখতে হবে ডিম্বাশয়ের বৃদ্ধিতে গর্ভধারণকারী নারীর শারীরিক কোন সমস্যা দেখা দিচ্ছে কিনা?

·        নারীর ডিম্বাশয় থেকে ডিম্ব আহরণ এবং নিষেকের পর জরায়ুতে প্রতিস্থাপনের পর ৩-৪দিন গর্ভপাত ঘটতে পারে এমন কোন ঔষধ সেবন করা উচি নয়।

·        সাধারণ ব্যায়াম করা যেতে পারে, তবে লক্ষ্য রাখতে হবে ডিম্বাশয়ের বৃদ্ধিতে গর্ভধারণকারী নারীর শারীরিক কোন সমস্যা দেখা দিচ্ছে কিনা?

·        গর্ভধারণকারী নারীদের সুষম স্বাস্থ্যকর খাওয়া এসময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওজন কমানোর জন্য কোন ডায়েট পরিবর্ত করা এসময় একদম উচিত নয়।

·        শূক্রানু এবং ডিম্বানু সংগ্রহের সময় স্বামী স্ত্রী কারো জ্বর থাকলে তাতে শুক্রানু বা ডিম্বানুর কোয়ালিটিতি প্রভাব পড়তে পারে।

এ পদ্ধতির জটিলতাসমূহ:

§  এ পদ্ধতিতে সন্তান গর্ভধারনের কয়েকদিন পরেই কোন কারন ছাড়াই গর্ভপাত হতে পারে।

§  যমজ বাচ্চা হওয়ার লক্ষণ থাকে। এমন কি তিন-চারটি শিশু হতে পারে।

§  সাধারনত মোটা মহিলা, বয়স্কা মহিলাদের ক্ষেএে এ পদ্ধতিতে সাফল্যের হার একটু কম।

§  এই পদ্ধতি অনেক ব্যয় বহুলএই চিকিৎসা পদ্ধতিতে একটি মাত্র নিষিক্ত ডিম্বাণুর ওপর নির্ভশীল না হয়ে চিকিৎসকগণ একাধিক ডিম্বাণু পৃথকের মাধ্যমে একাধিক ভ্রুণ তৈরির ব্যবস্থা করে থাকেন। একাধিক ভ্রূণ বেড়ে উঠলে নারীর প্রজননতন্ত্রে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।

টেস্টটিউব চিকিৎসার সফলতা

টেস্ট টিউব চিকিৎসার সাফল্যের হার সব সময়েই একই রকম থাকে এমনটি বলা যাবে না। সামগ্রিকভাবে এ পদ্ধতিকে গর্ভধারনে সাফল্যের হার ১৫-৩০শতাংশ।তার মধ্যে থেকে ২৫ থেকে ৩৫ বছরের মহিলাদের মধ্যে সাফল্যের হার ৩০ থেকে ৪০%। ৩৫ থেকে ৪০-এর মধ্যে ১৫ থেকে ২০% এবং ৪০থেকে ৪৫ এর  মধ্যে ১০ থেকে ১৫% । তবে চিকিৎসকগণ দম্পতিদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান ধারনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সফল না হলে তবেই এই জটিল পদ্ধতিতে সন্তানধারণের জন্য দম্পতিকে পরামর্শ দেয়া হয়।

[সুত্রঃ http://www.hfea.gov.uk/ivf-success-rate.html ]

যে সব কারণে টেস্ট টিউব পদ্ধতি ব্যর্থ হয়:

§  ডিম্বাশয়ে ডিম্বাণুর পরিপক্বতা লাভের জন্য নির্ণয় করা সময় সম্পর্কে ভুল অনুমান।

§  পৃথকীকরণের সময় ডিম্বাণু নষ্ট হলে।

§  ডিম্বাণু পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হওয়ার আগেই সরিয়ে ফেলা হলে

§  নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে ভ্রূণের বিকাশ না ঘটলে।

§  ভ্রূণ তৈরি হলেও তার বিকাশ ঠিক মতো না ঘটলে।

§  জরায়ুতে ভ্রুণের ত্রুটিপূর্ণ প্রতিস্থাপন।

§  ব্যবহৃত যন্ত্র ও প্রযুক্তির কোনরূপ ত্রটি থাকলে

যে সমস্যগুলো থাকলে টেষ্ট টিউব বেবী নেওয়া যায় না

·        স্বামীর শুক্রানু যদি ফার্টিলাইজেশনে অক্ষম হয়

·        স্ত্রীর ডিম্বাশয় থেকে নি:সৃত ডিম্বানু যদি ফার্টিলাইজেশনে অক্ষম হয়

·         জরায়ুতে স্বাভাবিক ফার্টিলাইজেশন হলেও হরমোনাল সমস্যার কারনে যাদের গর্ভপাত হওয়ার সমস্যা আছে

·        ডিম্বাশয়ে যদি ডিম্বানু পরিপক্কতা লাভ না করে।

·        ডিম্বাশয়ের যদি স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়

·        কোন শারীরিক সমস্যা বা কোন রোগের কারনে জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হলে

·        যেসব পুরুষের শুক্রাণু কম উৎপন্ন হয় বা বয়সের কারনে শুক্রাণুর সংখ্যা হ্রাস পেলে

                                                                                     

পরিশিষ্ট:

যখন কোনো দম্পতি সন্তান পেতে পুরোপুরি সকল চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তাদের অনেকেই তখন টেস্ট টিউব বেবির কথা ভাবেন। চিকিৎসকরাও তাদের টেস্ট টিউব বেবি নেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সন্তান লাভের এ প্রয়াসও যে শতভাগ সফল হবে সে ব্যাপারে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখনও সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত নন। সাধারণ ভাবে এ সব ক্ষেত্রে মায়ের বয়সের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। বেশি বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে এ চেষ্টা অনেক ক্ষেত্রে সফল নাও হতে পারে। তারপরও অনেক নি:সন্তান দম্পতিদের হাসি ফোটাচ্ছে এই টেস্ট টিউব বেবি।

আমাদের কেয়ার লাইনে ফোন করে রবি থেকে বৃহস্পতিবার (সরকারী ছুটির দিন বাদে) সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সুপারমম এর ডাক্তারদের সাথে সরাসরি পরামর্শ করতে পারেন মা ও শিশু বিষয়ক যেকোন সমস্যা নিয়ে আমাদের টোল ফ্রি নাম্বার ০৮-০০০-৮৮৮-০০০