শিশুর বিকাশে প্রথম ৩ বছর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। এই চলমান পরিবর্তনের স্রোত বদলে দিচ্ছে আমাদের জীবনধারা। অনেক বেড়ে গেছে আমাদের দায় দায়িত্ব। জীবনের তাগিদে আজকালকার আধুনিক বাবা-মা হিসেবে আমাদের যেমন সামলে চলতে হচ্ছে বহির্মুখী কর্মকাণ্ড, তেমনি দক্ষতার সাথে সামলাতে হচ্ছে ঘর-সংসার ও শিশু প্রতিপালনের মত গুরুদায়িত্ব। বাবা-মায়েরা শিশুর শারীরিক বিকাশ নিয়ে যথেষ্ট সচেতন থাকলেও তাদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রটা অনেকখানি অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। গর্ভ থেকে শুরু করে জন্মের পর প্রথম ৩ বছর অর্থাৎ লেখাপড়া শুরু করার আগের সময়টুকু-একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়। অথচ দেখা যায়- আধুনিক কালের অনেক শিশু এই সময়টাতেই পর্যাপ্ত পরিমাণ উদ্দীপনা বা স্টিমুলেশন ও স্বজনের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়- যা পরবর্তীকালে সৃষ্টি করে নানা জটিলতা, যেমন আচরণে অস্বাভাবিকতা, লেখাপড়ায় অমনোযোগিতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, খাওয়া-দাওয়ার প্রতি অনীহা ইত্যাদি।

একটি শিশুর জীবনে গর্ভ থেকে শুরু করে জন্মের পর প্রথম ৩ বছর কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, এই সময়টাতে শিশুর বিকাশে কে কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, শিশুর বিকাশের কোন কোন ক্ষেত্রে এ সময় লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন, কিভাবে শিশুদের বিকাশে সহায়তা করা সম্ভব, শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ কি সত্যিই পরবর্তীকালে তার জীবনযাপনের মান উন্নত করে কি না এ সব খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

উপরোক্ত বিষয়গুলোকে বিজ্ঞানভিওিক তথ্যের আলোকে নিম্নোক্ত উপায়ে ব্যাখ্যা করা যায়।

শিশুর জীবনে গর্ভ থেকে শুরু করে জন্মের পর প্রথম ৩ বছর কেন এত গুরুত্বপূর্ণ-

অসংখ্য গবেষণার ফলাফলের মাধ্যমে দেখা গেছে, শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ আরম্ভ হয় মাতৃগর্ভ থেকেই। জন্মের সময় শিশুর মস্তিষ্কের (ব্রেইনের) প্রায় অধের্ক অংশ তৈরি হয়ে যায়। মজার বিষয় হলো স্নায়ুকোষের সংখ্যা এ সময়েই নির্ধারিত হয়ে যায় এবং ৪ বছর বয়সের মধ্যে মস্তিষ্কের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই তৈরি হয়ে যায়। পরবর্তীকালে মস্তিষ্কের বৃদ্ধি নির্ভর করে মূলত স্নায়ুকোষের সংযোগ বৃদ্ধি ও কোষগুলোতে মাইলিনের আস্তর পড়ার ওপর। এর ফলে স্নায়ুকোষগুলো সুচারুরূপে কাজ করতে পারে। এ সময়ে শিশুর মস্তিষ্ক অতি দ্রুতহারে বৃদ্ধি পায় এবং তা সব ধরনের উদ্দীপনা বা স্টিমুলেশন গ্রহণ করার জন্য তৈরি থাকে। যে তথ্য বা অভিজ্ঞতা সে অর্জন করে, সেটাই

মস্তিষ্কের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে গেঁথে যায়। তাই আমরা দেখতে পাই কোনো কষ্ট ছাড়াই শিশুরা ছোট বয়সে তিন-চারটা ভাষাও অবলীলায় শিখে ফেলে। অথচ প্রাপ্ত বয়স্ক কোন মানুষকে নতুন ভাষা শিখতে গেলে অনেক কষ্ট করতে হয়।

শিশুর বিকাশে কারা সবচাইতে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে-

জন্মের পর থেকে শিশুর চারপাশের পরিচিত লোকেরাই তার বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রধান কারণ বাবা-মা সন্তানের সাথে অনেকটা সময় কাটান, তাদের নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসেন, সর্বদা তাদের মঙ্গল কামনা করেন এবং তাদের অন্যদের চেয়ে ভালভাবে বুঝতে পারেন। তাই সন্তানেরাও বাবা-মায়ের ওপর ভরসা ও নির্ভর করে। শিশুরা অনেক সময় তাদের বন্ধু-বান্ধব ও ভাই-বোনের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখে। তবে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, অন্য শিশুর কাছ থেকে শেখার চেয়ে বড়দের সহযোগিতার মাধ্যমে কোনোকিছু শিখলে শিশুদের বিকাশ বেশি হয়। বর্তমান যুগে পরিস্থিতি অনেক সময় এমন হয়ে যায় যে, মা-বাবা দুজনকেই জীবিকার জন্য কাজে বের হতে হয়। ফলে শিশুকে দেবার মতো যথেষ্ট সময় তাদের থাকে না। অনেকেই নির্ভর করে কাজের মানুষের ওপর। এ জন্য যতটুকু সময়ই তারা শিশুর কাছে থাকতে পারেন সে সময়টাকে মানসম্মত সময় করে তুলতে পারলে সেটা শিশুর বিকাশে অনেক অবদান রাখতে পারে। এক্ষেত্রে মায়ের সাথে বাবাকেও অনেকখানি সহযোগী হতে হবে। অথচ আমাদের সমাজে বাবারা সন্তানদের লালন-পালনের জন্য রোজগার করাটাকেই প্রধান কর্তব্য বলে মনে করেন। এর বাইরে সন্তানদের সঠিক বিকাশে তাদের যে আরও অনেক ভূমিকা থাকতে পারে সে বিষয়ে অনেকেরই ধারণা নেই। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, মা-বাবা দুজনেই যে সব সন্তানকে উদ্দীপনা দান করেছেন তাদের মানসিক বিকাশ ও স্কুলের ফলাফল ওদের চেয়ে ভাল যারা কেবল একজন অভিভাবকের যতœ পেয়েছে।

শিশুর বিকাশের কোন কোন ক্ষেত্রে প্রথম ৩ বছর লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন-

পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টির পাশাপাশি নিচে বর্ণিত ক্ষেত্রগুলোতে বিকাশের সুযোগ করে দিলে শিশু যথেষ্ট উদ্দীপনা পাবে-

 শারীরিক অঙ্গ-প্রতঙ্গের সঞ্চালন : শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যাঙ্গের§ নড়াচড়া শিশুর বিকাশের প্রাথমিক ধাপগুলোর একটি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মাসের একটি শিশুকে বিছানা বা চেয়ারে আটকে না রেখে ওকে হামাগুড়ি দেওয়ার মত সুযোগ করে দিলে সে তার মাংসপেশীগুলো সঞ্চালন করতে পারবে, তার পারিপার্শ্বিক জগতকে জানবে এবং ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলটি শিখবে। সেই সাথে তাদের ছোট ছোট মাংসপেশীর সঞ্চালনের কাজগুলোও করতে দিতে হবে, যেমন- গুটি ধরা, বোতলে গুটি ভরা, পেন্সিল দিয়ে দাগ দেওয়া ইত্যাদি। এতে চোখ ও হাতের সমন্বয়মূলক কাজগুলোতে দক্ষতা আসবে।

 পারিপার্শ্বিক জগতের সাথে পরিচিতি ও ভাষার আদান-প্রদান : শিশুকে§ পারিপার্শ্বিক জগতের সাথে পরিচিত করাতে হবে। সে বলতে পারুক বা না-পারুক তাকে বিভিন্ন জিনিসের নাম বলে চেনাতে হবে। মনের ভাব আদান-প্রদানে সহযোগিতা করতে হবে। শিশু নতুন নতুন কথা শিখলে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে তাকে উদ্দীপনা দিতে হবে। এতে শিশু আরও দ্রুত কথা বলতে ও মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখবে।

 মেলামেশা ও সামাজিকতা : শিশুকে সবার সাথে মেলামেশার সুযোগ করে দিতে§ হবে। অন্যদের সাথে মেলামেশা ও খেলাধুলার মাধ্যমে শিশু সামাজিক হতে শেখে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে, সাধ্যমত তার নিজস্ব জগতের বিভিন্ন রকম সমস্যার সমাধান করতে শেখে।

যেভাবে শিশুদের বিকাশে সহায়তা করা সম্ভব-

 ধৈর্যের সাথে শিশুকে পর্যবেক্ষণ করা : সবার আগে বাবা-মাকে খুব দক্ষতার§ সাথে শিশুকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। শিশুর আগ্রহ-অনাগ্রহ, দক্ষতা, দুর্বলতা ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাদের শিশুটি সর্ম্পকে একটি ধারণা তৈরি করে নিয়ে সে অনুযায়ী উদ্দীপনা দিতে হবে।

 ধাপে ধাপে কাজ শেখানো : শিশুর দক্ষতা ও বয়স অনুযায়ী তাকে ধাপে-ধাপে§ উদ্দীপনা দানের মাধ্যমে একের পর এক কাজ শেখাতে হবে। জানতে হবে শিশু তার কাজটা করতে কতটা আগ্রহী এবং তা করে সে আনন্দ পাচ্ছে কি না। শিশুর জন্য এমন ধরনের কাজ বা খেলনা নির্বাচন করতে হবে যা তার জন্য খুব কঠিন নয়, আবার খুব সহজও নয়। কারণ খেলা খুব সহজ হলে সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে আবার খুব কঠিন হলে সে হতাশ হয়ে তা থেকে বিরত থাকতে পারে।

 খেলায় নতুনত্ব ও বৈচিত্র্য আনা : শিশুরা খুব সহজেই কিছুক্ষণ খেলার পর§ ওই খেলনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাই, যে ধরনের জিনিস দিয়ে অনেক খেলনা বানানো যায় সে ধরনের খেলনা দিয়ে তাকে উদ্দীপনা দিতে হবে। এতে শিশু আনন্দ পাবে এবং তার চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটবে।

 ভালবাসা প্রকাশ করা, উৎসাহ দেওয়া ও প্রশংসা করা : শিশুর প্রতি§ ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে, প্রতিটি কাজে উৎসাহ দিতে হবে এবং কোন কাজ পারলে প্রশংসা করতে হবে। এতে শিশুর শেখার উৎসাহ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে।

 ভাষা শেখানো : শিশুর সাথে অনেক বেশি কথা বলতে হবে। তাহলে সে অনেক§ শব্দের সাথে পরিচিত হবে এবং কথা সাজিয়ে নিজে বলার চেষ্টা করবে। এটি তার ভাষাগত বিকাশে সহায়ক হবে।

 শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়ানো : শিশুকে নিজে নিজে কাজ করতে দিতে হবে।§ এক্ষেত্রে বাবা-মার ভূমিকা অনেক বেশিকোনো কাজে বা খেলায় বার বার বাধা দিলে তার শেখার আগ্রহ কমে যাবে এবং সে নতুন কিছু করতে ভয় পাবে। এতে সে ভীতু ও লাজুক প্রকৃতির হবে।

 খেলার ছলে মজা করে শেখানো : শিশুকে মজা আর আনন্দের সাথে কাজ শেখাতে§ হবে। পড়া লেখার জন্য অল্প বয়সে চাপ দেওয়া যাবে না। বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা যেমন, , , ৩ গণনা, রঙের নাম, বস্তুর আকার, যেমন কোনটা বড়, কোনটা ছোট, কোনটা লম্বা, কোনটা গোল, এবং অবস্থান, যেমন উপর-নিচ, ভিতর-বাহির ইত্যাদি খেলার ছলে আনন্দের সাথে আশপাশের জিনিসের উদাহরণ দিয়ে শেখাতে হবে। এতে তার শেখার প্রতি আগ্রহ বাড়বে এবং পরবর্তীকালে লেখাপড়ার প্রতি অনীহা জমবে না।

 শিশুকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করা : এ বিষয়ে প্রথমেই শিশুকে ভালভাবে বুঝে§ নিতে হবে। কোনো ধরনের দুষ্টমি করলে সে কেন তা করেছে সেটা আগে জেনে নিতে হবে। তারপর শিশুর পছন্দ-অপছন্দ বুঝে তাকে ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট কাজের দিকে আগ্রহী ও মনোযোগী করে তুলতে হবে। বকা, মারধোর বা শাসন করা শিশুর বিকাশের প্রবৃত্তিকে দমন করে দেয়। কোনো কিছু করতে বারণ করলে তার কারণ শিশুর বোঝার উপযোগী করে তাকে বুঝাতে হবে।

 কথা রাখা ও বিশ্বাস অর্জন : শিশুকে বুঝতে দিতে হবে যে, বাবা-মা তার§ সবচেয়ে আপন। শিশুর আস্থা অর্জনের জন্য তাকে কোনো কথা দিলে সেটা রাখার চেষ্টা করতে হবে এবং তাকে সবক্ষেত্রে সাহস দিতে হবে।

শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ পরবর্তীকালে তার জীবনযাপনের মান কতটা উন্নত করে-

জামাইকাতে ২০০৯ সালে পরিচালিত একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় দেখা গেছে, বছর বয়সের আগে যে সব শিশু সব ধরনের উদ্দীপনা বা স্টিমুলেশন পেয়েছে তারা ২৫ বছর বয়সেও যারা তা পায়নি তাদের চেয়ে লেখাপড়ায় বেশি ভাল করেছে। এ ছাড়া তারা বুদ্ধির পরীক্ষায় এবং আত্মবিশ্বাসেও ভাল ফলাফল দেখিয়েছে।

আজকের শিশু আগামীকালের নাগরিক- এ কথা মনে রেখে আমাদের সকলেরই উচিত শিশুদের তাদের পূর্ণ বিকাশের জন্য সুযোগ করে দেওয়া, তাদের চাহিদা বোঝার চেষ্টা করা এবং তাদের সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে সহযোগিতা করা। উদ্দীপনা বা স্টিমুলেশন দানের জন্য সব সময় কাছে থাকার প্রয়োজন নেই। প্রতিদিন ৩-৪ ঘণ্টা সময় বের করে শিশুকে তার দক্ষতা বুঝে উদ্দীপনা দিলেই সে পরিপূর্ণভাবে বিকাশের সুযোগ পাবে। তাই বাবা-মা দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে যে সময়টুকু শিশুর সাথে কাটান (যেমন খাবার সময়, খেলার সময়, ঘুমের সময়, গোসলের সময় ইত্যাদি) তাকে করে তুলতে হবে শিশুর জন্য স্মরণীয় একটি বিশেষক্ষণ।

লেখক
ডা. শাহজাদা সেলিম
এমবিবিএস, এমডি (এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম)
এমএসিই (ইউএসএ)
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
কমফোর্ট ডক্টরস্ চেম্বার
১৬৫-১৬৬, গ্রীন রোড, ঢাকা

Source: health.thereport24.com

অনুসন্ধান এর বিষয়

প্রাসঙ্গিক আর্টিকেল