পিরিয়ডের সময় সঠিক নিয়মে পরিচ্ছন্ন না থাকার পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে, এমনকি বন্ধ্যাত্ব!

হয়তো এই আর্টিকেলটি পড়া শুরুর আগেই আড়চোখে চারপাশে দেখে নিয়েছেন। কেউ নেই তো আবার! সমাজ আর সংস্কার আমাদেরকে এ বিষয়টাকে গোপনীয়তা আর লজ্জার চাদরে ঢেকে দিয়েছে। এটা এমনই যে মেয়েরা শুধু মায়ের কাছ থেকেই এ বিষয়ে জানে এবং তার কথা মতই পরিষ্কার থাকার চেষ্টা করেন।

মা কিন্তু শিখেছেন তার মায়ের কাছে। তার মানে বিষয়টা এমন হয়ে যাচ্ছে যে এখনো আমরা পিরিয়ড নিয়ে যা কিছু জানি (ভুল বা সঠিক) তার সব কিছু নানী দাদীদের বা তারচেয়েও পুরনো আমলের এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান যা কিছু সাজেস্ট করে, তার অনেক কিছুই আমরা জানতে পারিনি।

পিরিয়ডের সময়ে সঠিক নিয়মে পরিচ্ছন্ন না থাকলে মুত্রনালি এবং যোনিপথে বারবার ইনফেকশন হতে পারে। আপনিও যদি ভেবে থাকেন যে ইনফেকশন আর এমন কি, ওষুধ খেলেই সেরে যাবে, তাহলে ভুল করছেন!

এই ভুল ধারণা আজীবন বয়ে বেড়াতে না চাইলে আগে দেখে নিন যে পিরিয়ডের সময়ে পরিচ্ছন্ন না থাকার পরিণাম কী।

পিরিয়ডের সময় পরিচ্ছন্নতার অভাবে কী কী ক্ষতি হতে পারেঃ

ইউরিন ইনফেকশনঃ

ইউরিন ইনফেকশন বার বার হতে থাকলে কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এবং গর্ভধারনের আগ থেকেই এজাতীয় ইনফেকশন থাকলে অকাল গর্ভপাত বা প্রিম্যাচিউরড বেবি জন্ম নিতে পারে।

যোনিপথের ইনফেকশনঃ

যোনিপথের ইনফেকশন থাকা অবস্থায় আপনার জন্য স্বামী-সহবাস কষ্টদায়ক হবে, এবং ইনফেকশনে আক্রান্ত অবস্থায় আপনার যোনির স্বাভাবিক পি এইচ ব্যালান্স নষ্ট হয়ে যায় বলে শুক্রানুর পক্ষে ডিম্বানু নিসিক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর সহজ বাংলা হচ্ছে যে যদি আপনি বাচ্চা নেবার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন, তখন অনেক ঝামেলা হবে। এছাড়া বারবার বা দীর্ঘস্থায়ি ইনফেকশন আপনার বন্ধাত্বের কারণ হতে পারে।

সাদাস্রাব হবার অন্যতম কারণগুলোর একটিও কিন্তু মাসিক চলাকালিন পরিস্কার না থাকা।

সারভিক্যাল ক্যানসারঃ

জরায়ুর নিচের অংশে হওয়া ক্যানসারকেই সারভিকাল ক্যানসার বলা হয়। এই ক্যানসার চিকিৎসা না করা হলে মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। অন্যদিকে চিকিৎসা শুরু করা মানেই আপনি আর কোনদিন মা হতে পারবেন না। এখনো এই ক্যানসারের ভয়াবহতা যদি আপনার মনের মধ্যে দাগ কেটে না থাকে, তাহলে জেনে রাখুন যে ২০১০ সালের WHO স্টাডি বলছে আমাদের দেশের ক্যানসার আক্রান্ত নারীদের মধ্যে সারভিকাল ক্যানসার হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম। এই ঝুঁকিতে আছে আমাদের দেশের ৫ কোটিরও বেশি নারী। বাংলাদেশে বছরে ১৭ হাজারেরও বেশি নারী এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেনআরও জেনে রাখুন যে বাংলাদেশে সারভিকাল ক্যানসারে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে ৯৭ শতাংশের ক্ষেত্রেই রোগের কারণ পিরিয়ডকালীন পরিচ্ছন্নতার অভাব।

যোনিপথ প্রশস্ত বা ঢিলে হয়ে যাওয়া

ইতিমধ্যেই জেনেছেন যে পিরিয়ডের সময় সঠিক ভাবে ক্লিন না থাকলে বারবার ইনফেকশন হয়। আর এর ফলে যোনিপথ স্বাভাবিকের চেয়ে প্রশস্ত বা ঢিলে হয়ে যায়। দাম্পত্যজীবনে এটি বড় ধরণের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

অন্যান্য ক্ষতি

শারীরিক ক্ষতি ছাড়াও মাসিকের সময়ে সঠিকভাবে পরিচ্ছন্ন থাকতে না পারার ফলে আরও কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়।

সঠিকভাবে পরিচ্ছন্ন থাকতে না পারলে একটি মেয়ে এই সময়ে তার কনফিডেন্স হারিয়ে ফেলে, তাই তার বাইরে যাবার কাজ (যেমন স্কুল, অফিস, ইত্যাদি) বাধাগ্রস্ত হয়। পরিসংখ্যান বলে বাংলাদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ ছাত্রি মাসে অন্তত তিনদিন স্কুল মিস করে, এবং মহিলা টিচার রাও এবসেন্ট থাকেন অনেক ক্ষেত্রেই।

এই সমস্যাগুলোর আর্থিক ক্ষতি হয়তো এখনও বের করা সম্ভব হয়নি কিন্তু নিজে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন যে পিরিয়ডের জন্য প্রতিমাসে কিছু অনুপস্থিতির কারনে একটি মেয়ে পড়ালেখা বা চাকরিজীবনে কতটা পিছিয়ে পড়ছে।

অথচ পিরিয়ডের এই সময়টুকু যদি একজন মেয়ে সঠিকভাবে নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখার উপায় জানে, তাহলে সে অন্যান্য সময়ের মতোই তার পড়ালেখা বা কাজ চালিয়ে যেতে পারে।

পিরিয়ডের সময়ে পরিচ্ছন্ন থাকার সঠিক ৫টি স্টেপ

আর্টিকেলটি শুরু থেকে এই পর্যন্ত পড়ার পর পরিচ্ছন্ন না থাকার ঝুঁকি নিয়ে নিশ্চয়ই আপনার মনে এখন আর কোন সন্দেহ নেই। তাহলে চলুন পিরিয়ড চলাকালিন সময়ে নিজেকে ভালভাবে পরিচ্ছন রাখার নিয়মগুলো জেনে নেই।

সঠিক উপাদান ব্যবহার করুনঃ

মাসিক চলাকালিন সময়ে এখনও অনেকেই কাপড় বা তুলো ব্যবহার করছেন। জেনে রাখুন যে কাপড় যতই ধুয়ে নেয়া হোক, তা রোদে বাতাসেই আবার শুকাতে হয়। ফলে এটি পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত আছে কিনা তা কখনই বলা যাবেনা। তুলার ক্ষেত্রেও তাই। এছাড়া কাপড় বা তুলো মাসিকের ডিসচার্জ ভালভাবে শোষণ করতে পারেনা, ফলে ইনফেকশনের ঝুঁকি থেকেই যায়। এছাড়া লিক হয়ে কাপড়ে দাগ লেগে যাবার ভয় তো আছেই।

তাই উচ্চ শোষণ ক্ষমতা সম্পন্ন এবং আরামদায়ক স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করুন। প্যান্ট বা বেল্ট দুই ধরণের মধ্য থেকে আপনার পছন্দেরটাই ব্যবহার করুন।

নিয়মিত চেঞ্জ করুনঃ

একটা স্যানিটারি ন্যাপকিন সাধারনত ছয়ঘন্টার বেশি পড়ে থাকা উচিৎ না। এছাড়া পিরিয়ডের সবসময় ডিসচার্জ এর ফ্লো এক সমান থাকেনা। তাই হতে পারে যে পিরিয়ডের শুরুর দিকে বেশি রক্ত যাবার কারনে বার বার চেঞ্জ করতে হচ্ছে। তবে শেষের দিকে ফ্লো একদম কমে গেলেও কোন অবস্থাতেই একটা ন্যাপকিন সারাদিন ব্যবহার করবেন না।

নিয়মিত পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুনঃ

যোনিপথের বাইরের অংশে এবং চামড়া ভাঁজে রক্ত এবং জীবাণু আটকে যায়তাই দিনে কয়েকবার গরম পানি দিয়ে এই জায়গা গুলো ধুয়ে ফেলুন। বাইরে থাকা অবস্থায় গরম পানি পাওয়া যাবেনা, তাই সেক্ষেত্রে আগে বেবি ওয়াইপস দিয়ে আগে মুছে নিয়ে তারপর ধুয়ে ফেলুন। সাবান ব্যবহার করতে পারবেন তবে তা যেন যোনিপথের ভিতরে না যায়। প্রতিদিন গোসল করে ফেলুনএতে করে পরিচ্ছন্ন হবার পাশাপাশি পিরিয়ড চলাকালীন ক্লান্তি এবং পিঠ হাত-পা ব্যাথা ভাবও অনেকটা কমে যাবে।

ব্যবহৃত ন্যাপকিন সঠিকভাবে ফেলুনঃ

ব্যবহৃত ন্যাপকিন ডাস্টবিনে ফেলার আগে অনেকেই বাসার বাথরুমের বিনে রেখে দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে ন্যাপকিন ফেলার আগে তা পলিথিনে মুড়ে তারপর ফেলবেন। কারণ তা না হলে জীবাণু ছড়িয়ে যেতে পারে এবং ইনফেকশনে আক্রান্ত হতে পারেন আপনি সহ বাথরুম ব্যবহারকারি যে কেউ।

একসাথে একটির বেশি ন্যাপকিন ব্যবহার করবেন নাঃ

পিরিয়ডের শুরুর দিকে হেভি ফ্লো থাকায় অনেকে একসাথে দুটি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে চান। দুটি ন্যাপকিন এর মিলিত শোষণক্ষমতার কারনে রক্ত হয়তো দেখাই যায়না তাই দীর্ঘ সময় পরেও আপনি ভাবেন যে ন্যাপকিনগুলো আরও কিছু সময় পরে থাকা যাবে।

রক্ত হয়তো চোখে দেখা যায়না, কিন্তু জীবাণু কিন্তু ঠিকই সংক্রমণ ঘটানোর জন্য তৈরি হয়ে যায়। তাই একবারে একটাই ন্যাপকিন নিন, এবং ব্যবহার শেষে (অবশ্যই ছয় ঘন্টার বেশি না) চেঞ্জ করে নিন।

পরিশিষ্টঃ

পিরিয়ড নিয়ে কথা তো আমরা কারও সাথে শেয়ার করিনা। আর এর ফলে এই নিয়ে যা কিছু জানার দরকার, তা আপনি বা আমই কেউই জানতে পারছিনা।

নারীদেহের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে সংস্কার আর লজ্জায় আর কতকাল ঢেকে রাখব? যেখানে দেখতেই পাচ্ছেন যে না জানা এবং না মেনে চলার ফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে?

তাই পিরিয়ড নিয়ে অহেতুক অস্বস্তি না রেখে এই নিয়ে আরও জানার এবং জানাবার চেষ্টা করুন। আপনার এবং আপনার পরিচিতদের সচেতন করার জন্য এই আর্টিকেলটি শেয়ার করুন।

আমাদের কেয়ার লাইনে ফোন করে রবি থেকে বৃহস্পতিবার (সরকারী ছুটির দিন বাদে) সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সুপারমম এর ডাক্তারদের সাথে সরাসরি পরামর্শ করতে পারেন মা ও শিশু বিষয়ক যেকোন সমস্যা নিয়ে। আমাদের নাম্বার টোল ফ্রি নাম্বার ০৮-০০০-৮৮৮-০০০